মঞ্চে যখন তাঁর পায়ের ছন্দ বাজে, প্রতিটি নৃত্যের মুদ্রা যেন এক একটি নতুন গল্পের জন্ম দেয়। সেই গল্প দর্শকদের হৃদয়ে জাগায় নতুন আবেগ, উন্মোচন করে কল্পনার এক ভিন্ন জগৎ। তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশের নৃত্যকলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র গৌতম চন্দ্র দাশ সুমন। হবিগঞ্জের এই প্রতিভাবান শিল্পী শুধু একজন নৃত্যশিল্পীই নন, তিনি একাধারে নৃত্য প্রশিক্ষক, নৃত্য পরিচালক এবং বাংলাদেশে কুচিপুড়ি নৃত্যের একজন অগ্রদূত। তাঁর নৃত্যের প্রতিটি পরিবেশনা দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। হবিগঞ্জের এই কৃতি সন্তান বাংলাদেশের নৃত্যকলায় এক বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর নৃত্যজীবন এবং কুচিপুড়ি নৃত্যের প্রসারে তাঁর স্বপ্ন ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ঘোষপাড়ায় জন্ম নেওয়া গৌতম চন্দ্র দাশ সুমন ছোটবেলা থেকেই নৃত্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। মা-বাবার একমাত্র পুত্র সুমন শৈশবে হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সুরবিতান ললিতকলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যখন তিনি নৃত্যচর্চা শুরু করেন, তখন এই শিল্পকে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রাথমিক বাধাগুলো অনুভব করতে শুরু করেন। সমাজের নানা কটু কথা এবং নৃত্যকে সমাজের গুরুত্ব না দেওয়ার মানসিকতার বিরুদ্ধে তাঁকে মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে হয়েছে। তবুও, নৃত্যের প্রতি অদম্য ভালোবাসা নিয়ে তিনি তাঁর প্রথম নৃত্যগুরু গৌতম আচার্য্যের কাছে সৃজনশীল নৃত্য ও লোকনৃত্যে তালিম নেওয়া চালিয়ে যান। নিজের আগ্রহ ও চেষ্টায় ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষক মুসা খানের কাছে লোকনৃত্যের তালিম নেন। নৃত্যকলার বিভিন্ন আঙ্গিকে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে সুমন বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী ও নৃত্য পরিচালকের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত নৃত্য কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন – বাংলাদেশের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী, নৃত্য পরিচালক ও নৃত্য গবেষক লুবনা মরিয়ম, নৃত্যশিল্পী ও নৃত্য পরিচালক দীপা খন্দকার এবং নৃত্যশিল্পী ও নৃত্য পরিচালক তামান্না রহমান প্রমুখ। সুমন বলেন, “এই প্রশিক্ষণ গ্রহণের পথও মসৃণ ছিল না, বহু দূরত্বের পথ অতিক্রম করে ঢাকায় আসা-যাওয়া এবং গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্যে সুযোগ পাওয়াও এক ধরনের সংগ্রামেরই অংশ ছিল।”
বর্তমানে গৌতম দাশ সুমন বাংলাদেশে কুচিপুড়ি নৃত্যকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি গুরু শ্রীমতী ববি চক্রবর্তীর (আইসিসিআর প্যানেল আর্টিস্ট, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, রূপকল্পম সোসাইটি, ভারত) কাছে কুচিপুড়ি নৃত্যের তালিম নিয়েছেন। হবিগঞ্জে শ্রীমতী ববি চক্রবর্তীর মাধ্যমে সুমন “বি.সি.জি বাংলাদেশ কুচিপুড়ি ডান্স এসোসিয়েশন” প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে “বাংলাদেশ কুচিপুড়ি ডান্স সেন্টার” নামে পরিবর্তিত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী কুচিপুড়ি নৃত্যের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। বছরে দুবার শ্রীমতী ববি চক্রবর্তী নিজে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এছাড়াও নিয়মিত অনলাইন ও অফলাইন ক্লাসের মাধ্যমে এই নৃত্যশৈলীর চর্চা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও মঞ্চে এবং বিদেশের মঞ্চেও কুচিপুড়ি নৃত্য দল ও শিল্পী হিসেবে গৌতম দাশ সুমন এবং তাঁর দল নৃত্য পরিবেশন করেছেন। তিনি বলেন, “কুচিপুড়ি শুধু একটি নৃত্যশৈলী নয়, এটি আমার সংগ্রাম, আমার ভালোবাসা। আমি স্বপ্ন দেখি, এই নৃত্যের মাধুর্য বাংলাদেশের প্রতিটি হৃদয়ে স্পন্দিত হবে, আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের সৃজনশীলতার পূর্ণ বিকাশে এই শিল্পকলার আলো খুঁজে পাবে।”
গৌতম দাশ সুমনের একমাত্র লক্ষ্য বাংলাদেশের মানুষকে একটি নতুন ক্লাসিকাল নৃত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং আগামী প্রজন্মকে সৃজনশীল মেধায় বিকশিত করা। এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি বাংলাদেশে কুচিপুড়ি নৃত্যের প্রচলন শুরু করেছেন। কুচিপুড়ি নৃত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি সম্প্রতি সিটি প্রেস ক্লাব সাংবাদিক কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক স্তরের সিটি প্রেস ক্লাব অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ অর্জন করেন। সিটি প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো. রাশেদুল ইসলাম গৌতম দাশ সুমনের কুচিপুড়ি নৃত্যে বিশেষ অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “এই শাস্ত্রীয় নৃত্যকে বাংলাদেশে পরিচিত করানো এবং এর প্রসারে তাঁর উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই স্বীকৃতি তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মে আরও উৎসাহ যোগাবে।” অপরদিকে, সিটি প্রেস ক্লাব পুরস্কারে ভূষিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নৃত্যশিল্পী মোহাম্মদ দ্বীপ গৌতম দাশ সুমনের এই অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “গৌতম দাশ সুমন বাংলাদেশে কুচিপুড়ি নৃত্যকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। আমি সর্বদা সুমনকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি এবং এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে তাঁর সেই নিরলস পরিশ্রমের ফল।”
পেশাগত জীবনে গৌতম দাশ সুমন জেলা শিল্পকলা একাডেমি হবিগঞ্জের নৃত্য প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি নৃত্যকুঁড়ি নৃত্যালয়, হবিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা, নৃত্য প্রশিক্ষক ও নৃত্য পরিচালক এবং হবিগঞ্জ সাংস্কৃতিক পরিষদের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। শিল্পকলার অন্যান্য মাধ্যম যেমন সঙ্গীত ও অভিনয়ের প্রতিও তাঁর আগ্রহ রয়েছে। নাট্যমেলা হবিগঞ্জে তিনি নাট্যকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। গৌতম চন্দ্র দাশ সুমনের এই একাগ্রতা এবং কুচিপুড়ি নৃত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নৃত্যকলায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।